weovj
-ew¼gP›`ª P‡Ævcva¨vq

চাহিয়া দেখিলাম- হঠাৎ কিছু বুঝিতে পারিলাম না। প্রথমে মনে হইল, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রপ্ত হইয়া আমার নিকট আফিং ভিক্ষা করিতে আসিয়ছে। প্রথমে উদ্যমে, পাষাণবৎ কঠিন হইয়া, বলিব মনে করিলাম যে, ডিউক মহাশয়কে ইতিপূর্বে যথোচিত পুরষ্কার দেওয়া গিয়াছে,এক্ষণে আর অতিরিক্ত পুরষ্কার দেওয়া যাইতে পারে না। বিশেষ অপরিমিত লোভ ভালো নাহে । ডিউক বলিল ”মেও!”
তখন চক্ষু চাহিয়া ভালো করিয়া দেখিলাম যে ওয়েলিংটন নহে। একটি ক্ষুদ্র মার্জার; প্রসন্ন আমার জন্য যে দুগ্ধ রাখিয়া গিয়াছিল, তাহা নিঃশেষ করিয়া উদরসাৎ করিয়াছে, আমি তখন ওয়াটার্লুর মাঠে ব্যূহ রচনায় ব্যাস্ত, অত দেখি নাই। এক্ষণে মার্জারসুন্দরী, নির্জল দুগ্ধপানে পরিতৃপ্ত হইয়া আপন মনে সুখ এ জগতে প্রকটিত করিবার অভিপ্রায়ে, অতি মধুর স্বরে বলিতেছেন, ”মেও” বলিতে পারি না,বুঝি তাহার ভিতর একটু ব্যঙ্গ ছিল; বুঝ, মার্জার মনে মনে হাসিয়া আমার পানে চাহিয়া ভাবিতেছিল, ”কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই।” বুঝি সে ”মেও!” শব্দে একটু মন বুঝিবার অভিপ্রায় ছিল। বুঝি বিড়ালের মনের ভাব, ”তোমার দুধ ত খাইয়া বসিয়া আছি- এখন বল কী?”বলি কী? আমি তো ঠিকরিতে পারিলাম না। দুধ আমার বাপেরও নয়। দুধ মঙ্গলার, দুহিয়াছে প্রসন্ন। অতএব সে দুগ্ধে আমারও যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই; সুতরাং রাগ করিতে পারি না। তবে চিরাগত একটি প্রথা আছে যে বিড়ালে দুধ খাইয়া গেলে, তাহাকে তাড়াইয়া মারিতে হয়। আমি যে সেই চিরাগত প্রথার অবমাননা করিয়া মনুষ্যকূলের কুলাঙ্গার স্বরূপে পরিচিত হইব, ইহাও বাঞ্ছনীয় নহে। কী জানি, এই মার্জারী যদি স্বজাতিমন্ডলে কমলাকান্তকে কাপুরুষ বলিয়া উপহাস করে? অতএব পুরুষের ন্যায় আচরণ করাই বিধেয়। ইহা স্থির করিয়া, সকাতরচিত্তে, হস্তে হইতে হুঁকা নামাইয়া, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্ন যষ্টি আবিষ্কৃত করিয়া সগবে মার্জারীর প্রতি ধাবমান হইলাম।
মার্জারী কমলাকান্তকে চিনিত ; সে যষ্টি দেখিয়া বিশেষ ভীত হওয়ার কোনো লক্ষণ প্রকাশ করিল না। কেবল আমার মুখপানে চাহিয়া হাই তুলিয়া, একটু সরিয়া বসিল। বলিল, ”মেও!” প্রশ্ন বুুুঝিতে পারিয়া যষ্টি ত্যঠস করিয়া পুনরপি শয্যায় আসিয়া হুঁকা লইলাম। তখন দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হইয়া, মার্জারের বক্তব্যসকল বুঝিতে পারিলাম।
বুঝিলাম যে, বিড়াল বলিতেছে, ”মারপিট কেন? স্থির হইয়া হাতে করিয়া একটি বিচার করিয়া দেখ দেখি? এ সংসারের ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি মৎস্য, মাংস সকলই তোমরা খাইবে, আমরা কিছু পাইব না কেন? তোমরা মনুষ্য, আমরা বিড়াল, প্রভেদ কী? তোমাদের ক্ষৎপিপাসা আছে-আমাদের কি নাই? তোমরা খাও, আমাদের আপত্তি নাই; কিন্তু আমরা খাইলেই তোমরা কোন শাস্ত্রানুসারে ঠেঙ্গা লাঠি লাইয়া মারিতে আইস, তাহা আমি বহু অনুসন্ধানে পাইলাম না। তোমরা আমার কাছে কিছু উপদেশ গ্রহণ কর। বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষালাভ ব্যতীত তোমাদের জ্ঞানোন্নতির উপায়ন্তর দেখি না। তোমাদের বিদ্যালয় সকল দেখিয়া আমার বোধ হয়, তোমরা এত দিনে এ কথাটি বুঝিতে পারিয়াছ।
দেখ শয্যাশায়ী মনুষ্য! ধর্ম কী? পরোপকারই পরম ধর্ম। এই দুগ্ধটুকু পান করিয়া আমরা পরম উপকার হইয়াছে।তোমার আহরিত দুগ্ধে এই পরোপকার সিদ্ধ হইল- অতএব তুমি গেন পরম ধর্মের ফলভাগী-আমি চুরিই করি আর যাই করি,আমি তোমার ধর্মসঞ্চয়ের মূলীভূত কারণ। অতএব আমাকে প্রহার না করিয়া,আমার প্রশংশা কর।আমি তোমার ধর্মের সহায়।
দেখ আমি চোর বটে কিন্তু আমি কি সাধে করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁহারা বড় বড় সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাঁহারা অনেকে চোর অপেক্ষাও অধর্মিক। তাঁহাদের চুরি করিবার প্রয়োজন নাই বালিয়াই চুরি করেন না। কিন্তু তাঁহাদের প্রয়োজনাতীত ধন থাকিতেও চোরের প্রতি যে মুখ তুলিয়া চাহেন না, ইহাতেই চোরে চুরি করে। অর্ধম চোরের নহে-চোরে যে চুরি করে, সে অধর্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধণী তদপেক্ষা শত গুণে দোষী। চোরের দন্ড হয়; চুরির মূলে যে কৃপণ, তাহার দন্ড হয় না কেন?
দেখ, আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করিয়া বোড়াই, কেহ আমাকে মাছের কাঁটাখানাও ফেলিয়া দেয় না। মাছের কাঁটা, পাতের ভাত, নর্দমায় ফেলিয়া দেয় জল ফেলিয়া দেয়, জলে ফেলিয়া দেয়, তথাপি আমাকে ডাকিয়া দেয় না। তোমাদের পেট ভরা, আমার পেটের ক্ষুধা কী প্রকারে জানিবে! হায়! দরিদ্রের জন্য ব্যথিত হইলে তোমাদের কি কিছু অগৌরব আছে? আমার মতো দরিদ্রের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, লজ্জার কথা সন্দেহ নাই। যে কখনো অন্ধকে মুুষ্টি-ভিক্ষা দেয় না, সেও একটা বড় রাজা ফাঁপরে পড়িলে রাত্রে ঘুমায় না- সকলেই পরের ব্যথায় ব্যথিত হইতে রাজি। তবে ছোটলোকের দুঃখে কাতর! ছি! কে হইবে? দেখ, যদি অমুক শিরোমণি, কি অমুক ন্যায়ালংকার আসিয়া তোমার দুধটুকু খাইয়া যাইতেন, তবে তুমি কি তাঁহাকে ঠেঙ্গা লইয়া মারিতে আসিতে? বড়ং জোড়হাত করিয়া বলিতে, আর একটু কি আনিয়া দিব? তবে আমার বেলা লাঠি কেন? তুমি বলিবে, তাঁহারা অতি পন্ডিত, বড় মান্য লোক। পন্ডিত বা মান্য বলিয়া কি আমার অপেক্ষা তাঁহাদের ক্ষাধা বেশি? তা তো নয়- তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ- দরিদ্রর ক্ষুধা কেহ বুঝে না। যে খাইতে বলিলে বিরক্ত হয় তাহার জন্য ভোজের আয়োজন কর- আর যে ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহŸানেই তোমার অন্ন খাইয়া ফেলে, চোর বলিয়া তাহার দান্ড কর- ছি! ছি!
দেখ, আমাদিগের দশা দেখ, দেখে প্রাচীরে প্রাচীরে, প্রঙ্গণে প্রাঙ্গনে প্রাসাদে প্রাসাদে মেও মেও করিয়া আমরা চারিদিক দৃষ্টি করিতেছি- কেহ আমাদিগকে মাছের কাঁটাখানা ফেলিয়া দেয় না। যদি কেহ তোমাদের সোহাগের বিড়াল হইতে পারিল- গৃহমার্জর হইয়া, বৃদ্ধের নিকট যুবতী ভার্যার সহোদর, বা মূর্খ ধনীর কাছে সতরঞ্চ খেলোয়াড়ের স্থানীয় হইয়া থাকিতে পারিলে-তবেই তাহার পুষ্টি। তাহার লেজ ফুলে, গায়ে লোম হয় এবং তাহাদের রুপের ছটা দেখিয়া, অনেক মার্জার কবি হইয়া পড়ে।
আর, আমাদিগের দশা দেখ- আহারাভাবে উদর কৃশ, আছি পরিদৃশ্যমান, লাঙ্গুল বিনত, দাঁত বাহির হইয়াছে-জিহŸা ঝুলিয়া পড়িয়াছে-অবিরত আহারাভাবে ডাকিতেছি, ’মেও! মেও! খাইতে পাই না!-’ আমাদের কালো চামড়া দেখিয়া ঘৃণা করিও না! এ পৃথিবীর মাংসে আমাদের কিছু অধিকার আছে। খাইতে দাও- নহিলে চুরি করিব। আমাদের কৃষ্ধসঢ়;ঞ চর্ম, শুষ্ক মুখ, ক্ষীণ সকরুণ মেও মেও শুনিয়া তোমাদিগের কি দুঃখ হয় না? চোরের দন্ড আছে, নির্দয়তার কি দন্ড নাই? দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দন্ড আছে, ধনীর কার্পণ্যের দন্ড নাই কেন? তুমি কমলাকান্ত, দূরদর্শী, কেন না আফিংখোর, তুমিও কি দেখিতে পাও না যে, ধনীর দোষেই দরিদ্রে চোর হয়? পাঁচ শত দরিদ্রকে বঞ্চিত করিয়া একজন পাঁচ শত লোকের আহার্য সংগ্রহ করিবে কেন? যদি না দেয়, তবে দরিদ্র অবশ্য তাহার নিকট হইতে চুরি করিবে; কেননা, অনাহারে মরিয়া যাইবার জন্য এ পৃথিবীতে কেহ আইসে নাই।
আমি আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিলাম, ”থাম! থাম মার্জারপন্ডিত! তোমার কথাগুলি ভারি সোশিয়ালিস্টিক! সমাজবিশৃঙ্খলার মূল! যদি যাহার ঐু ক্ষমতা, সে তত ধনসঞ্চয় করিতে না পায়, অথবা সঞ্চয় করিয়া চোরের জ্বালায় নির্বিঘেœ ভোগ করিতে না পায়, তবে কেহ আর ধনসঞ্চয়ে যতœ করিবে না। তাহাতে সমাজের ধনবৃদ্ধি হইবে না”।
মার্জার বলিল, ”না হইলে ত আমার কী? সমাজের ধনবৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধনবৃদ্ধি। ধনীর ধনবৃদ্ধি না হইলে দরিদ্রের কী ক্ষতি?
আমি বুঝাইয়া বলিলাম যে, ”সামাজিক ধনবৃদ্ধি ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই।” বিড়াল রাগ করিয়া বলিল যে, ”আমি যদি খাইতে না পাইলাম,তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কী করিব?”
ডবড়ালকে বুঝান দায় হইল। যে বিচারক বা নৈয়য়িক, কাস্মিনকালে কেহ তাহাকে কিছু বুঝাইতে পারে না। এ মার্জার সুবিচারক এবং সুতার্কিকও বটে, সুতরাং না বুঝিবার পক্ষে ইহার অধিকার আছে। অতএব ইহার উপর রাগ না করিয়া বলিলাম, ”সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকিতে পারে, কিন্তু ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন, অতএব চোরের দন্ডবিধান কর্তব্য।”
মার্জারী মহাশয়া বলিলেন,” চোরকে ফাঁসি দাও , তাহাতেও আমার আপত্তি নাই, কিন্তু তাহার সঙ্গে আর একটি নিয়ম কর। যে বিচারক চোরকে সাজা দিবেন, তিনি আগে তিন দিবস উপবাস করিবেন। তাহাতে যদি তাঁহার চুরি করিয়। খাইতে ইচ্ছা না করে, তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দিবেন। তুমি আমাকে লাঠি তুলিয়াছিলে, তুমি অদ্য হইতে তিন দিবস উপবাস করিয়া দেখ। তুমি যদি ইতিমধ্যে নসীরাম বাবুর ভান্ডারঘরে ধরা না পড়, তবে আমাকে ঠেঙ্গাইয়া মারিও, আমি আপত্তি করিব না।”
বিজ্ঞ লোকের মত এই যে যখন বিচার পরাস্ত হইবে, তখন গম্ভীরভাবে উপদেশ প্রদান করিবে। আমি সেই প্রথানুসারে মার্জারকে বলিলাম যে, ”এ সকল অতি নীতিবিরুদ্ধ কথা, ইহার আন্দেলনেও পাপ আছে। তুমি এ সকল দুশ্চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া ধর্মাচরণে মন দাও। তুমি যদি চাহ, তবে পাঠার্থে তোমাকে আমি নিউমান ও পার্করের গ্রন্থ দিতে পারি। আর কমলাকান্তের দপ্তর পড়িলেও কিছু উপকার হইতে পারে- আর কিছু হউক বা না হউক, আফিঙের অসীম মহিমা বুঝিতে পারিবে। এক্ষণে স্বস্থানে গমন কর, প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দিবে বলিয়াছে, জলযোগের সময় আসিও, উভয়ে ভাগ করিয়া খাইব। অদ্য আর কাহারও হাঁড়ি খাইও না; বরং ক্ষুধায় যদি নিতান্ত অধীর হও, তবে পুনর্বার আসিও, এক সরিষাভোর আফিং দিব।”
মার্জার বলিল, ” আফিঙের বিশেষ প্রয়োজন নাই, তবে হাঁড়ি খাওয়ার কথা, ক্ষুধানুসারে বিবেচনা করা যাইবে।”
মার্জার বিদায় হইল। একটি পতিত আতœাকে অন্ধকার হইতে আলোকে আনিয়াছি, ভাবিয়া কমলাকান্তের বড় আনন্দ হইল!
0 comments:
Post a Comment