Tuesday, 18 February 2020

অপরিচিতা


অপরিচিতা  
                          -রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর
 আজ আমার বয়স সাতাশ মাত্র। এ জীবন না দৈর্ঘের হিসাবে বড় না গুনের হিসাবে। তবু  ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে। ইহা গেন ফুলের মতো যাহার বুকের উপর ভ্রমর আসিয়া বসিয়াছিল এবং সেই পদক্ষেপের ইতিহাস তাহার জীবনের মাঝখানে ফলের মতো গুটি ধরিয়া উঠিয়াছে।সেই ইতিহাসটুকু আকারে ছোট,তাহাকে ছোট করিয়াই লিখিব। ছোটকে যাঁহারা সামান্য বলিয়া ভুল করেন না তাঁহারা ইহার রস বুঝিবেন।
কলেজে যতগুলো পরিক্ষা পাস করিবার সব আমি চুকাইয়াছি।ছোটবেলায় আমার সুন্দর চেহারা লইয়া পন্ডিতমাশায় আমাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সহিত চেহারা লইয়া পন্ডিতমশায় আমাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সহিত তুলনা করিয়া বিদ্রুপ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। ইহাতে তখন বড়ো ল্জ্জা পাইতাম, কিন্তু বয়স হইয়া এ কথা ভাবিয়াছি, যদি জন্মান্তর থাকে তবে আমার মুখে সরুপ এবং পন্ডিতমাশায়দের মুখে বিদ্রুপ আবার যেন  অমনি করিয়াই প্রকাশ পায়।
আমার পিতা এক কালে গরিব ছিলেন। ওকালতি করিয়া তিনি প্রচুর টাকা রোজগার করিয়াছেন,ভোগ করিবার সময় নিমেষমাত্রও পান নাই। মৃত্যুতে তিনি যে হাঁফ ছাড়িলেন সেই তাঁর প্রথম অবকাশ। আমার তখন বয়স অল্প। মার হাতেই আমি মানুষ। মা গরিবের ঘরের মেয়ে, তাই আমার যে ধনী এ কথা তিনিও ভোলেন না, আমাকে ভুলিতে দেন না।শিশুকাল আমি কোলে কোন মানুষ-বোধ করি, সেইজন্য শেষ পর্যন্ত আমার পুরোপুরি বয়সই হইল না। আজও আমাকে দেখিলে মনে হইবে,আমি অন্নপূর্ণার কোলে গজাননের ছোট ভাইটি। আমার আসল অভিভাবক মামা। তিনি আমার চেয়ে বড়োজোর বছর ছয়েক বড়। কিন্তু ফল্গুন বালির মতো তিনি আমাদের সমস্ত সংসারটাকে অন্তরের মধ্যে শুষিয়া লইয়াছেন।তাঁহাকে না খুঁড়িয়া এখানকার এক গন্ডুষ ও রস পাইবার জো নাই। এই কারণে কোন কিছুর জন্যই আমাকে কোনো ভাবনা ভাবিতেই হয় না।কন্যার পিতা মাত্রেই স্বীকার করিবেন আমি সৎপাত্র।তামাকটুকু পর্যন্ত খই না।ভালোমানুষ হওয়ার কোনো ঝঞ্ঝাট নাই, তাই আমি নিতান্ত ভালোমানুষ। মাতার আদেশ মানিয়া চলিবার ক্ষমতা আমার আছে-বস্তুত,না মানিবার ক্ষমতা আমার নাই। অন্তঃপূবের শাসনে চলিবার মতো করিয়াই আমি প্রস্তুত হইয়াছি,যদি কোন কন্য স্বয়ম্বরা হন তবে এই সুলক্ষণটি স্মরণ রাখিবেন।অনেক বড়ো ঘর হইতে আমার সম্বন্ধ আসিয়াছিল।কিন্তু মামা যিনি ‍পৃথিবীতে আমার ভাগ্যদেবতার প্রধান এজেন্ট,বিবাহ সম্বন্ধে তাঁর একটা বিশেষ মত ছিল। ধনীর কন্যা তাঁর  পচ্ছন্দ নয়। আমাদের ঘরে যে মেয়ে আসিবে সে মাথা হেট করিয়া আসিবে,এই তিনি চান।অথচ টাকার প্রতি আসক্তি তাঁর অস্থিমজ্জায় জড়িত। তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা নাই আথচ  যে টাকা দিতে কসুর করিবে না।যাহাকে শোষণ করা চলিবে আথচ বাড়িতে আসিলে গুড়গুড়ির পরিরর্তন|যাহোক শোষণ করা চলিবে অথচ বাড়িতে আসিলে গুড়গুড়ির পরিবর্তে বাঁধা হুাঁকায় তামাক দিলে যাহার নালিশ খাটিবে না।আমার বন্ধ হরিশ কানপুরে কাজ করে। সে ছুটিতে কলিকাতায় আসিয়া আমার মন উতলা করিয়া দিল। সে বলিল,ওহে, মেয়ে যদি বল একটি খাসা মেয়ে আছে।কিছুদিন পূর্বে এম এ পাশ করিয়াছি। সামনে যত দূর পর্যন্ত  দৃষ্টি চলে ছুটি ধূ ধূ করিতেছে, পরীক্ষা নাই, উমেদরি নাই, চাকরি নাই, নিজের বিষয়ে দেখিবার চিন্তাও নাই, শিক্ষাও নাই, ইচ্ছাও নাই থাকিবার মধ্যেও ভিতরে আছেন মা এবং বাহিরে আছেন মামা। এই অবকাশের মরুভূমির মধ্যে আমার হৃদয় তখন বিশ্বব্যািপী নারীরূপের মরীচিকা দেখিতেছে-আকাশে তাহার দৃষ্টি,বাতাসে তাহার নিঃশ্বাস,তরুমর্মরে তাহার গোপন কথা।এমন সময় হরিশ আসিয়া বলিল,মেয়ে যদি বল তবে-।আমার শরীর-মন বসন্তবাতাসে বকুলবনের নবপল্লবরশির মতো কাঁপিতে কাঁপিতে আলোছায়া বুনিতে লাগিল। হরিশ মানুষটা ছিল রসিক,রস দিয়াবর্ণনা করিবার শক্তি তাহার ছিল,আর আমাার মতো ছিল তৃষার্ত ।
 আমি হরিশকে বলিলাম,একবার মামার কাছে কথাটা পাড়িয়া দেখো। হরিশ আসার জামাইতে অদ্বিতীয়। তাই সর্বত্রই তাহার খাতির। মামাও তাহাকে পাইলে ছাড়িতে চান না। কথাটি তাঁর বৈঠকে উঠিল। মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের খবারটাই তাঁহার কাছে গুরুতর। বাপের অবস্থা তিনি যেমনটি চান তেমনি। এক কালে ইহাদের বংশে লক্ষীর মঙ্গলঘট ভরা ছিল।এখন তাহা শূন্য বলিলেই হয়,অথচ তলায় সামান্য কিছু বাকি আছে। দেশে বংশমার্যাদা রাখিয়া চলা সহজ নয় বলিয়া ইনি পশ্চিমে গিয়া বাস করিতেছেন।সেখানে গরিব গৃহস্থের মতোই থাকেন। একটি মেয়ে ছাড়া তাঁর আর নাই। সুতরাং তাহারই পশ্চাত লক্ষীর ঘটটি একেবারে উপুড় করিয়া দিতে দ্বিধা হইবে না।
এসব ভলো কথা।কিন্তু মেয়ের বয়সে সে পনেরো, তাই শুনিয়া মামার মন ভার হইল। বংশের তো কোনো দোষ নাই? না, দোষ নাই-বাপ কোথাও তাঁর মেয়ের যোগ্য বর খুঁজিয়া পান না। একে তো বরের হাট মহর্ঘ,তাহার পরে ধনুক-ভাঙা পণ,কাজেই বাপ কেবলই সবুর করিতেছেন-কিন্তু মেয়ের বয়স সবুর করিতেছেন না।যাই হোক ,হরিশের সরস রসনার গুণ আছে।মামার মন নরম হইল।বিবাহের ভূমিকা-অংশটা নির্বিঘ্নে সামাধা হইয়া গেল। কলিকাতার বাহিরে বাকি যে পৃথিবীটা আছে সমস্তটাকেই মামা আন্ডারমা দ্বীপের অন্তর্গত বলিয়া জানেন। জীবনে একবার বিশেষ কাজে তিনি কোন্নগর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মামা যাদি মনু হইতেন তবে তিনি হাবড়ার পুল পার হওয়াটাকে তাঁহার সংহিতায় একেবারে নিষেধ করিয়া দিতেন। মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল, নিজের চেখে মেয়ে দেখিয়া আসিব। সাহস করিয়া প্রস্তাব করিতে পারিলাম না।
কন্যাকে আশীর্বাদ করিবার জন্য যাহাকে পাঠানো হইল সে আমাদের বিনুদাদা,আমার পিসতুতো ভাই। তাহার মতো রুচি এবং দক্ষতার পরে আমি ষোলো-আনা নির্ভর করিতে পারি। বিনুদা ফিরিয়া বলিলেন, মন্দ নায় হে! খাঁটি সোনা বটে!
বিনুদাদার ভাষাটা অতন্ত আঁট।যেখানে আমার বলি চমৎকার সেখানে তিনি বলেন চলনসই। অতএব বুঝিলাম, আমার ভা্গ্যে প্রজাপাতির সঙ্গে পঞ্চাশরের কোন বিরোধ নাই।
বলা বাহুল্য,বিবাহ-উপলক্ষে কন্যাপক্ষেকেই কলিকাতায় আসিতে হইল। কন্যার পিতা শম্ভুনাথবাবু হরিশকে কত বিশ্বাস করেন তাহার প্রমাণ এই যে,বিবাহের তিন দিন পূর্বে তিনি আমাকে প্রথম চক্ষে দেখেন এবং আর্শীবাদ করিয়া যান। বয়স তাঁর চল্লিশের কিছু এপারে বা ওপারে।চুল কাঁটা, গোঁফে পাকা ধরিতে আরম্ভ করিয়াছে মাত্র।সুপুরুষ বটে। ভিড়ের মধ্যে দেখিলেন সকলের আগে তাঁর উপরে চোখ পড়িবার মতো চেহারা।
আশা করি আমাকে দেখিয়া তিনি খুশি হইয়াছিলেন। বোঝা শক্ত,কেননা তিনি বড়ই চুপচাপ। যে দুটি-একটি কথা বলেন যেন তাহাকে পুরো জোর দিয়া বলেন না। মামার মুখ তখন অনর্গল ছুটিতেছিলেন-ধনে মানে আমাদের স্থান যে শহরের কারও চেয়ে কম নয়,সেইটেকেই তিনি নানা প্রসঙ্গে প্রচার করিতেছিলেন। শম্ভুনাথবাবু এ কথায় একেবারে যোগই দিলেন না-কোনো ফাঁকে একটা হুঁ বা হ্যাঁ কিছুই শোনা গেল না।আমি হইলে দমিয়া যাইতাম,কিন্তু মামাকে দমানো শক্ত। তিনি শম্ভুনাথবাবুর চুপচাপ ভাব দেখিয়া ভাবিলেন,লোকটা নিতান্ত নির্জীব,একেবারে কোনো তেজ নাই।বেহাই-সম্প্রদয়ের আর যাই থাক,তেজ থাকাটা দেষের,অতএব মামা মনে মনে খুশি হইলেন।শম্ভুনাথবাবু যখন উঠিলেন তখন মামা সংক্ষেপে উপর হইতেই তাঁকে বিদায় করিলেন,গাড়িতে তুলিয়া দিতে গেলেন না।
পণ সম্বন্ধে দু্ই পক্ষে পাকাপাকি কথা ঠিক হইয়া গিয়াছিল।মামা নিজেকে অসামান্য চতুর বলিয়াই আভিমান করিয়া থাকেন। কথাবর্তায় কোথাও তিনি কিছু ফাঁকা রাখেন নাই।টাকার অঙ্ক তো স্থির ছিলেন,তারপরে গহনা কত ভরির েএবং সোনা কত দরের হইবে সেও একেবারে বাঁধাবাঁধি হইয়া গিয়াছিল। আমি নিজে এসমস্ত কথার মধ্যে ছিলাম না,জানিতাম না দেনা-পাওনা কী স্থির হইল। মনে জানিতাম,এই স্থুলে অংশটাও বিবাহের একটা প্রধান অংশ,এবং সে অংশের ভার যার উপর তিনি  এক কড়াও ঠকিবেন না। বস্তুত,আশ্চার্য পাকা লোক বলিয়া মামা আমাদের সমস্ত সংসারের প্রধান গর্বের সামগ্রী।যেখানে আমাদের কোনো সম্বন্ধ আছে সেখানে সর্বত্রই তিনি বুদ্ধির লড়াইয়ে জিতিবেনি,এ একেবারে ধরা কাথা,এই জন্য আমাদের অভাব না থাখিলেও এবং অন্য পক্ষের অভাব কঠিন হইলেও জিতিব,আমাদের সংসারের এই জেদ-ইহাতে যে বাঁচুক আর যে মরুক।

গায়ে-হলুদ অসম্ভব রকম ধুম করিয়া গেল। বাহক এত গেল যে তাহার আদম-শুমারি করিতে হইলে কেরানি রাখিতে হয়। তাহাদিগের বিদায় করিতে অপর পক্ষকে যে নাকাল হইতে হইবে,সেই কথা স্মরণ করিয়া মামার সঙ্গে মা একযোগে বিস্তার হাসিলেন।
ব্যান্ড,বাঁশি,শখের কন্সার্ট প্রভিতি যেখানে যতপ্রকার উচ্চ শব্দ আছে সমস্ত একসঙ্গে মিশাইয়া বর্বর কোলাহলের মত্ত হস্তী দ্বারা সংগীত সরস্বতীর পদ্মবন দলিত বিদলিত করিয়া আমি তো বিবাহ-বড়িতে গিয়া উঠিলাম। আংটিতে হারেতে জরি-জহরাতে আমার শরীর যেন গহনা দেকান নিলামে চড়িয়াছে বলিয়া বোধ হইল। তাঁহাদের ভাবী জামাইয়ের মূল্য কত সেটা যেন কতক পরিমাণে সর্বাঙ্গে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়অ ভাবী শ্বশুরের সঙ্গে মোকাবিলা করিতে চলিয়াছিলাম। মামা বিবাহ-বাড়িতে ঢুকিয়া খুশি হইলেন না। একে তো উঠানটাতে বরযাত্রীদের জায়গা সংকুলান হওয়াই শক্ত, তাহর পরে সমস্ত আয়োজন নিতান্ত মধ্যম রকমের। ইহার পরে শম্ভুনাথবাবুর ব্যাবহারটাও নেহাত ঠান্ডা। তাঁর বিনয়টা অজ¯্র নয়। মুখে তো কথাই নাই কোমরে চাদর বাঁধা, গলা ভাঙা, টাক-পড়া, মিশ-কলো এবং বিপুল-শরীর তাঁর একটি উকিল-বন্ধু যদি নিয়ত হাত জোড় করিয়া মাথা হেলাইয়া,ন¤্রতার স্মিতহাস্যে ও গদগদ বচনে কন্সর্ট পাটির করতাল-বজিয়ে হইতে শুরু করিয়া বরকর্তাদের প্রত্যেককে বার বার প্রচুররূপে অভিষিক্ত করিয়া না দিতেন তবে গোড়াতেই এাঁ এসপার-ওসপাড় হইতে।
আমি সভায় বসিবার কিছুক্ষণ পরেই মামা শম্ভুনাথবাবুকে পাশের ঘরে ডকিয়া লইয়া গেলেন। কী কথা হইল জানি না, কিছুক্ষণ পরই শম্ভুনাথবাবু আমাকে আসিয়া বলিলেন,”বাবাজি, একবার এই দিকে আসতে হচ্ছে।” ব্যাপারখানা এই।-সকলের না হউক,কিন্তু কোনো কোনো মানুষের জীবনের একটি কিছু লক্ষ্য থাকে। মামার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তিনি কোনোমতেই কারও কাছে ঠকিবেন না। তাঁর ভয় তাঁর বেহাই তাঁকে গহনার ফাঁকি দিতে পারেন-বিবাহকর্য শেষে হইয়া গেলে সে ফাঁকির আর প্রতিকার চলিবে না। বাড়িভাড়া সওগাদ লোক-বিদায় প্রভৃতি সম্বন্ধে যেরকম টানাটানি পরিচয় পাওয়া গেছে তাহাতে মামা ঠিক করিয়াছিলেন-দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে এ লোকটির শুধু মুখের কথার উপর ভর করা চলিবে না। সেইজন্য বাড়ির সেকরাকে সুদ্ধ সঙ্গে আনিয়াছিলেন। পাশের ঘরে গিয়ে দেখিলাম মামা এক তক্তপোশে এবং সেকরা তাহার দাঁড়িপাল্লা কষ্টিপাথর প্রভৃতি লইয়া মেজেয় বসিয়া আছে।
সম্ভুনাথবাবু আমাকে বলিলেন,”তোমার মামা বলিতেছেন বিবাহের কাজ শুরু হইবার আগেই তিনি কনের সমস্ত গহনা যাচাই করিয়া দেখিবেন,ইহাতে তুমি কী বল।”
আমি মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া রহিলাম।
মামা বলিলেন,”ও আবার কী বলিবে। আমি যা বলিব তাই হইবে।”
শম্ভুনাথবাবু আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন,”সেই কথা তবে ঠিক? উনি যা বলিবেন তাই হইবে? এ সম্বন্ধে তোমার কিছুই বলিবার নাই?”
আমি একটু ঘাড়-নাড়ার ইঙ্গিত জানাইলাম, এসব কথায় আমার সম্পূর্ণ অনধিকার।
”আচ্ছা তবে বোসো,মেয়ের গা হইতে সমস্ত গহনা খুলিয়া আনিতেছি।” এই বলিয়া তিনি উঠিলেন।
মামা বলিলেন,”অনুপম এখানে কী করিবে। ও সভায় গিয়া বসুক।”
শম্ভুনাথবাবু বলিলেন,”না, সভায় নয়, এখানেই বসিতে হইবে।”
কিছুক্ষণ পরে তিনি একখানা গামছায় বাঁধা গহনা আনিয়া তক্তপোশের উপর মেলিয়া ধরিলেন। সমস্তই তাঁহার পিতামহীদের আমলেন গহনা-হাল ফ্যাশনের সূক্ষ কাজ নয়-যেমন মোটা তেমন ভারী।
সেকরা গহনা হাতে তুলিয়া বলিল,”এ আর দেখিব কী। ইহাতে খাদ নাই-এমন  সোনা এখনকার দিনে ব্যাবহারই হয় না।”
এই বলিয়া সে মকরমুখা মোটা একখানা বালার একটু চাপ দিয়া দেখাইল তাহা বাঁকিয়া যায়।
মামা তখনই নোটবইয়ের গহনাগুলির ফর্দ টুকিয়া লইলেন, পাছে যাহা দেখানো হইল তাহার কোনোটা কম পড়ে। হিসাব করিয়া দেখিলেন, গহনা যে পরিমাণ দিবার কথা এগুলি সংখ্যায়,দরে এবং ভারে তার অনেক বেশি। গহনাগুলির মধ্যে একজোড়া এয়ারিং ছিল। শম্ভুনাথ সেইটে সেকরার হাতে দিয়া বলিলেন, এইটেক একবার পরখ করিয়া দেখো।”
সেকরা কহিল, ”ইহা বিলাতি মাল, ইহাতে সোনার ভাগ সামান্যই আছে।”
শম্ভুবাবু এয়রিং জোড়া মামার হাতে দিয়া বলিলেন,”এটা আপনারাই রাখিয়া দিন।”
মামা সেটা হাতে লইয়া দেখিলেন, এই এয়ারিং দিয়াই তাঁহারা আশীর্বাদ করিয়াছিলেন।
মামার মুখ লালা হইয়া উঠিল। দরিদ্র তাঁহাকে ঠাকাইতে চাহিবে কিন্তু তিনি ঠকিবেন না এই আনন্দ-সম্ভোগ হইতে বঞ্চিত হইলেন এবং তাহার উপরও কিছু উপরি-পাওনা জুটিল। অত্যন্ত মুখ ভার করিয়া বলিলেন,”অনুপম,যাও তুমি সভায় গিয়ে বোসো গে।”
শম্ভুনাথবাবু বলিলেন,”না,এখন সভায় বসিতে হবে না। চলুন,আগে আপনাদের খাওয়াইয়া দিই।”
মামা বলিলেন,”সে কী কথা। লগ্ন-”
শম্ভুনাথবাবু বলিলেন,”সেজন্য কিছু ভাবিবেন না-এখন উঠুন।”
লোকটা নেহাত ভালোমানুষ-ধরণের কিন্তু বেশ একটু জোর আছে বলিয়া বোধ হইল। মামাকে উঠিতে হইল। বরযাত্রীদেরও আহার হইয়া গেল। আয়োজনের আড়ম্বর ছিল না। কিন্তু রান্না ভালো এবং সমস্ত বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বলিয়া সকলেই তৃপ্তি হইল।
বরযাত্রীদের খাওয়া শেষ হইলে শম্ভুনাথবাবু আমাকে খাইতে বলিলেন। মামা বলিলেন,”সে কী কথা। বিবাহের পূর্বে বর খাইবে কেমন করিয়া।”
এ সম্বন্ধে মামার কোনো মতপ্রকাশকে তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন,”তুমি কী বল। বাসিয়া যাইতে দোষ কিছু আছে?”
মূর্তিমতী মাতৃ-আজ্ঞা-স্বরূপে মামা উপস্থিত, তাঁর বিরুদ্ধে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি আহরে বসিতে পারিলাম না।
তখন শম্ভুনাথবাবু মামাকে বলিলেন,”আপনাদিগকে অনেক কষ্ট দিয়াছি। আমরা ধনী নই, আপনাদের যোগ্য আয়োজন করিতে পারি নাই,ক্ষমা করিবেন। রাত হইয়া গেছে, আর আপনাদের কষ্ট বাড়াইতে ইচ্ছো করি না।
এখন তবে-”
এামা বলিলেন,”তা,সভায় চলুন, আমরা তো প্রস্তুত আছি।”
কম্ভুনাথ বলিলেন, ”তবে আপনাদের গাড়ি বলিয়া দিই?”
মামা আশ্চার্য হইয়া বালিলেন, ”ঠাট্টা করিতেছেন নাকি।”
শম্ভুনাথ কহিলেন,”ঠাট্টা তো আপনিই করিয়া সারিয়েছেন। ঠাট্টার সম্পর্কটাকে স্থায়ী করিবার ইচ্ছা আমার নাই।”
মামা দুই চোখ এত বড়ো করিয়া মেলিয়া অবাক হইয়া রহিলেন।
শম্ভুনাথ কহিলেন,”আমর কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে করে তাদের হাত আমি কন্যা দিতে পারি না।”
আমাকে একটি কথা বলাও তিনি আবশ্যক বোধ করিলেন না। কারণ,প্রমাণ হইয়া গেছে, আমি কেহই নই। তারপর যা হইল সে আমি বলিতে ইচ্ছা করি না। ঝাড়লণ্ঠন ভাঙিয়া-চুড়িয়া, জিনিসপত্র লন্ডভন্ড করিয়া, বরযাত্রের দল দক্ষযজ্ঞের পালা সারিয়া বাহির হইয়া গেল।
ঊাড়ি ফিরিবার সময় ব্যন্ড রসনচৌকি ও কন্সার্ট একসঙ্গে বাজিল না এবং অভ্রের ঝাড়গুলো আকাশের তারার উপর আপনাদের কর্তব্যের বরাত দিয়া কোথায় যে মহানির্বাণ লাভ করিল সন্ধান পাওয়া গেল না।
ঊাড়ির সকলে তো রাগিয়া আগুন। কন্যার পিতার এত গুমর। কলি যে চারপোয়া হইয়া আসিল! সকলে বলিল, ”দেখি, মেয়ের বিয়ে দেন কেমন করিয়া।” কিন্তু মেয়ের বিয়ে হইবে না এ ভয় যার মনে নাই তার শাস্তির উপায় কি।
মস্ত বাংলাদেশে মধ্যে আমিই একমাত্র পুরুষ যাহাকে কন্যার বাপ বিবাহের আসর হইতে নিজে ফিরাইয়া দিয়াছে। এত বড় সাহস সৎপাত্রের কপালে এত বড় কলঙ্কের দাগ কোন নষ্ট গ্রহ এত আলো জ্বালাইয়া, বাজনা বাজাইয়া, সমারোহ করিয়া আঁকিয়া দিল? বরযত্রীরা এই বলিয়া কপালে চাপড়াইতে লাগিল যে,”বিবাহ হইল না অথচ আমাদের ফাঁকি দিয়া খাওয়াইয়া দিল- পাকযন্ত্রটাকে সমস্ত অন্নসুদ্ধ সেখানে টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া আসিতে পারিলে তবে আফসোস মিটিত।”
বিবাহের চুক্তিভঙ্গ ও মানহানির দাবিতে নালিশ করিব বলিয়া মামা অত্যন্ত গোল করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। হিতৈষীরা বুঝাইয়া দিল, তাহা হইলে তামাশার যেটুকু বাকি আছে তাহা পুরা হইবে।
বলা বাহুল্য,আমিও খব রাগিয়াছিলাম। কোনো গতিকে শম্ভুনাথ বিষম জব্দ হইয়া আমাদের পায়ে ধরিয়া আসিয়া পড়েন, গোঁফের রেখায় তা দিতে দিতে এইটেই কেবল কামনা করিতে লাগিলাম।
কিন্তু, এই আক্রোশের কালো রঙের স্রোতের পাশাপাশি আর একটা ¯্রােত বহিতেছিল যেটার রঙ একেবারেই কালো নয়। সমস্ত মন যে সেই অপরিচিতার পানে ছুটিয়া গিয়াছিল-এখানো যে তাহাকে কিছুতেুই টানিয়া ফিরাইতে পারি না। দেয়ালটুকুর আড়ালে রহিয়া গেল গো। কপালে তার চন্দন আঁকা, গায়ে তার লাল শাড়ি, মুখে তার লজ্জায় রক্তিমা, হৃদয়ের ভিতরে কী যে তা কেমন করিয়া বলিব। আমার কল্পলোকের কল্পলতাটি বসন্তের সমস্ত ফুলের ভার আমাকে নিবেদন করিয়া দিবার জন্য নত হইতে পড়িয়াছিল। হাওয়া আসে, গন্ধ পাই, পাতার শব্দ শুনি-কেবল আর একটিমাত্র পা ফেলার অপেক্ষা-এমন সময়ে সেই এক পদক্ষেপের দূরত্বটুকু এক মুহুর্তে অসীম হইয়া উঠিল!
এতদিন যে প্রতি সন্ধ্যায় আমি বিনুদাদার বাড়িতে গিয়া তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিলাম! বিনুদার বর্ণনার ভাষা অত্যন্ত সংকীর্ণ বলিয়াই তাঁর প্রত্যেক কথাটি স্ফুলিঙ্গের মতো আমার মনের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়া দিয়াছিল। বুঝিয়াছিলাম মেয়েটির রূপ বড়ো আশ্চর্য; কিন্তু না দেখিলাম তাহাকে চোখে, না দেখিলাম তাহার ছবি, সমস্তই অস্পষ্ট হইয়া রহিল। বাহিরে তো সে ধরা দিলই না, তাহাকে মনেও আনিতে পারিলাম না-এইজন্য মন সেদিনকার সেই বিবাহসভার দেয়ালটার বাহিরে ভূতের মতো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বেড়াইতে লাগিল।
হরিশের কাছে শুনিয়াছি, মেয়েটাকে আমার ফটোগ্রাফ দেখানো হইয়াছিল। পছন্দ করিয়াছে বৈকি। না করিবার তো কোন কারণ নাই। আমার মন বলে, সে ছবি তার কোনো একটি বাক্সের মধ্যে লুকানো আছে। একলা ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া এক-একদিন নিরালা দুপুরবেলায় সে কি সেটি খুলিয়া দেখে না? হঠাৎ বাহিরে কারও পায়ের শব্দ পাইলে সে কি তাড়াতাড়ি তার সুগন্ধ আঁচলের মধ্যে ছবিটিকে লুকাইয়া ফেলে না?
দিন যায়। একটা বৎসর গেল। মামা তো লজ্জায় বিবাহসম্বন্ধের কথা তুলিতেই পারেন না। মার ইচ্ছা ছিল,আমার অপমানের কথা যখন সমাজের লোকে ভুলিয়া যাইবে তখন বিবাহের চেষ্টা দেখিবেন।
এদিকে আমি শুনিলাম সে মেয়ের নাকি ভালো পাত্র জুটিয়াছিল, কিন্তু সে পণ করিয়াছে বিবাহ করিবে না। শুনিয়া আমার মন পুলকের আবেশে ভরিয়া গেল। আমি কল্পনায় দেখিতে লাগিলাম, সে ভালো করিয়া খায় না; সন্ধ্যা হইয়া আসে, সে চুল বাঁধিতে ভুলিয়া যায়।তার বাপ তার মুখের পানে চান আর ভাবেন, ”আমার মেয়ে দিনে দিনে এমন হইয়া যাইতেছে কেন।”হঠাৎ কোনোদিন তার ঘরে আসিয়া দেখেন, মেয়ের দুই চক্ষু জলে ভরা। জিজ্ঞাস করেন,”মা তোর কী হইয়াছে বল আমাকে।” মেয়ে তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া বলে,” কই কিছুই তো হয় নি বাবা।” বাপের এক মেয়ে যে বড় আদরের মেয়ে। যখন অনাবৃষ্টির দিনে ফুলের কুঁড়িটির মতো মেয়ে একেবারে বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছে তখন বাপের প্রাণে আর সহিল না। তখন অভিমান ভাসাইয়া দিয়া তিনি ছিটিয়া আসিলেন দ্বারে। তার পরে? তার পরে মনের মধ্যে সেই যে কালো রঙের ধারাটা বাহিতেছে সে যেন কালো সাপের মতো রুপ ধরিয়া ফোঁস করিয়া উঠিল। সে বলিল,”বেশ তো, আর একবার বিবাহের আসর সাজানো হোক, আলো জ্বলুক,দেশ-বিদেশ লোকের নিমন্ত্রণ হোক, তার পরে তুমি বরের টোপর পায়ে দলিয়া দলবল লইয়া সভা ছাড়িয়া চলিয়া এসো।” কিন্তু,যে ধারাটি চোখের জলের মতো শুভ্র সে রাজহংসের রুপ ধরিয়া বলিল,”যেমন করিয়া আমি একদিন দময়ন্তীর পুষ্পবনে গিয়াছিলাম,তেমনি করিয়া আমাকে একবার উড়িয়া যাইতে দাও-আমি বিরহিণীর কানে কানে একবার সুখের খবরটা দিয়া আসি গে।” তারপর? তারপরে দুঃখের রাত পোহালেই, নববর্ষার জল পড়িল,¤øান ফুলটি মুখ তুলিল-এবারে সেই দেয়ালটার বাহিরে রহিল সমস্ত পৃথিবীর আর সবাই আর ভিতরে প্রবেশ করিল একটিমাত্র মানুষ। তার পরে? তার পরে আমার কথাটি ফুরালো।

কিন্তু, কথা এমন করিয়া ফুরাইল না। যেখানে আসিয়া তাহা অফুরান হইয়াছে সেখানকার বিবরণ একটুখানি বলিয়া আমার এ লেখা শেষ করিয়া দিই।
মাকে লইয়া তীর্থে চলিয়ছিলাম। আমার উপরেই ভার ছিল। করণ মামা এবারেও হাবড়ার পুল পার হন নাই। রেলগাড়িতে ঘুমাইতেছিলাম। ঝাঁকানি খাইতে খাইতে মাথার মধ্যে নানাপ্রকার এলো মেলো স্বপ্নের ঝুমঝুমি বজিতেছিল। হঠাৎ একটা কোন স্টেশনে আসিয়া জাগিয়া উঠিলাম। আলোতে অন্ধকার মেশা সেও এক স্বপ্ন। কেবল আকাশের তারাগুলি চিরপরিচিত-আর সবই অজানা অস্পষ্ট; স্টেশনে দীপ-কয়টা খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া আলো ধরিয়া এই পৃথিবীটা যে কত অচেনা এবং যাহা চারিদিকে তাহা যে কতই বহু দূরে তাহাই দেখাইয়া দিতেছে। গাড়ির মধ্যে মা ঘুমাইতেছেন; আলোর নিচে সবুজ পর্দা টানা; তোরঙ্গ বাক্স জিনিসপত্র সমস্তই কে কার ঘাড়ে এলোমেলো হইয়া রহিয়াছে, তাহারা যেন স্বপ্নলোকের উলট-পালট আসবাব, সবুজ প্রদোষের মিটমিটে আলোতে থাকা এবং না-থাকার মাঝখানে কেমন একরকম হইয়া পড়িয়া আছি।
এমন সময়ে সেই অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত রাত্রে কে বলিয়া উঠিল,” শিগগির চলে আয় এই গাড়িতে জায়গা আছে।” মনে হইল,যেন গান শুনিলাম। বাঙ্গালি মেয়ের গলায় কথা যে কী মধুর তাহা এমনি করিয়া অসময়ে অজায়গায় আচমকা শুনিলে তবে সম্পূর্ণ বুঝিতে পারা যায়। কিন্তু,এই গলাটিকে কেবলমাত্র মেয়ের গলা বলিয়া একটি শ্রেণিভুক্ত করিয়া দেওয়া চলে না, এ কেবল একটি মানুষের গলা; শুনিলেই মন বলিয়া ওঠে,”এমন তো আর শুনি নাই।
চিরকাল গলার স্বর আমার কাছে বড়ো সত্য। রুপ জিনিসটি বড়ো কম নয়, কিন্তু মানুষের মধ্যে যাহা অন্তরতম এবং অনির্বচনীয়, আমার মনে হয় কন্ঠস্বর যেন তারই চেহারা। আমি তাড়াতাড়ি গাড়ির জানালা খুলিয়া বাহিরে মুখ বাড়াইয়া দিলাম, কিছুই দেখিলাম না। প্লাটফর্মের অন্ধকারে দাঁড়াইয়া গার্ড তাহার একচক্ষু লন্ঠন নাড়িয়া দিল, গাড়ি চলিল; আমি জানালার কাছে বসিয়া রহিলাম। আমার চোখের সামনে কোনো মূর্তি ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে আমি একটি হৃদয়ের রুপ দেখিতে লাগিলাম। সে যেন এই তারাময়ী রাত্রির মতো, আবৃত করিয়া ধরে কিন্তু তাহাকে ধরিতে পারা যায় না। ওগো সুর, অচেনা কন্ঠের সুর, এক নিমিষে তুমি যে আমার চিরপরিচয়ের আসনটির উপরে আসিয়া বসিয়াছ। কী আশ্চর্য পরিপূর্ণ তুমি-চঞ্চল কালের ক্ষুব্ধ হৃদয়ের উপরে ফুলটির মতো ফুটিয়াছে, অথচ তার ঢেউ লাগিয়া একটা পাপড়িও টলে নাই, অপরিমেয় কোমলতায় এতটুকু দাগ পড়ে নাই।
গাড়ি লোহার মৃদঙ্গে তাল দিতে দিতে চলিল; আমি মনের মধ্যে গান শুনিতে শুনিতে চলিলাম। তাহার একটিমাত্র ধুয়া-” গাড়িতে জায়গা আছে।” আছে কি, জায়গা আছে কি। জায়গা যে পাওয়া যায় না,কেউ যে কাকেও চেনে না। অথচ সেই না-চেনাটুকু যে কুয়াশামাত্র, সে যে মায়া, সেটা ছিন্ন হইলেই যে চেনার আর অন্ত নাই। ওগো সুধাময় সুর, যে হৃদয়ের অপরুপ রুপ তুমি, সে কি আমার চিরকালের চেনা নয়। জয়গা আছে আছে-শীঘ্র আসিতে ডাকিয়াছ, শীঘ্রই আসিয়াছি, এক নিমেষও দেরি করি নাই।
রাত্রে ভালো করিয়া ঘুম হইল না। প্রায় প্রতি স্টেশনে একবার করিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিলাম, ভয় হইতে লাগিল যাহাকে দেখা হইল না সে পাছে রাত্রে নামিয়া যায়। পরদিন সকালে একটা বড়ো স্টেশনে গাড়ি বদল করিতে হইবে। আমাদের  ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট-মনে আশা ছিল,ভিড় হইবে না। নামিয়া দেখি,প্লাটফর্মে সাহেবদের আর্দালি-দল আসবাবপত্র লইয়া গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিতেছে। কোন এক ফৌজের বড় জেনারেল সাহেব ভ্রমণে বাহির হইয়াছেন। দুই-তিন মিনিট পরেই গাড়ি আসিল। বুঝিলাম, ফার্স্ট ক্লাসের আশা ত্যাগ করিতে হইবে। মাকে লইয়া কোন গাড়িতে উঠি সে এক বিষম ভাবনায় পড়িলাম। সব গাড়িতেই ভিড়। দ্বারে দ্বারে উঁকি মারিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। এমন সময়ে সেকেন্ড ক্লাসের গাড়ি হইতে একটি মেয়ে আমার মাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন,”আপনারা আমাদের গাড়িতে আসুন না-এখানে যায়গা আছে।”
আমি তো চমকিয়া উঠিলাম। সেই আশ্চার্যমধুর কণ্ঠ এবং সেই গানেরই ধুয়া-”জায়গা আছে।” ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া মাকে লইয়া গাড়িতে উঠিয়া পড়িলাম। জিনিসপত্র তুলিবার প্রায় সময় ছিল না। আমর মতো অক্ষম দুনিয়াতে নাই। সেই মেয়েটিই কুলিদের হাত হইতে তাড়াতড়ি চলিত গাড়িতে আমাদের বিছানাপত্র টানিয়া লইল। আমর একটা ফটোগ্রাফ তুলিবার ক্যামেরা স্টেশনেই পড়িয়া রহিল-গ্রাহ্যই করিলাম না।
তার পরে-কী লিখিব জানি না। আমার মনের মধ্যে একটি অখন্ড আনন্দের ছবি আছে-তাহাকে কোথায় শুরু করিব,কোথায় শেষ করিব? বসিয়া বসিয়া বাক্যের পর বাক্য যোজনা করিতে ইচ্ছা করে না।
এবার সেই সুরটিকে চোখে দেখিলাম; তখনো তাহাকে  সুর বলিয়াই মনে হইল। ময়ের মুখের দিকে চাহিলাম; দেখিলাম তাঁর চোখে পলক পড়িতেছে না। মেয়েটির বয়স ষোলো কি সতেরো হইবে, কিন্তু নবযৌবন ইহার দেহে মনে কোথাও যেন একটুও ভার চাপাইয়া দেয় নাই। ইহার গতি সহজ, দীপ্তি নির্মল, সৌন্দর্যের শুচিতা অপূর্ব, ইহার কোনো যায়গায় কিছু জড়িমা নাই।
আমি দেখিতেছি, বিস্তারিত করিয়া কিছু বলা আমর পক্ষে অসম্ভব। এমন কি সে যে কী রঙের কাপড় কেমন করিয়া পরিয়াছিল তাহাও ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না। এটা খুব সত্য যে, তার বেশে ভূষায় এমন কিছুই ছিল না যেটা তাহাকে ছাড়াইয়া বিশেষ করিয়া চোখে পড়িতে পারে। সে নিজের চারিদিকের সকলের চেয়ে অধিক-রজনীগন্ধার শুভ্র মঞ্জরীর মতো সরল বৃন্তটির উপরে দাঁড়াইয়া, যে গাছে ফুটিয়াছে সে গাছকে সে একেবারে অতিক্রম করিয়া উঠিয়াছে। সঙ্গে দুটি-তিনটি ছোটো মেয়ে ছিল, তাহাদিগকে লইয়া তাহার হাসি এবং কথার অন্ত ছিল না। আমি হাতে একখানা বই লইয়া সে দিকে কান পাতিয়া রাখিয়াছিলাম। যেটুকু কানে আসিতেছিল সে তা সমস্তই ছেলেমানুষদের সঙ্গে ছেলেমানুষি কথা। তাহার বিশেষত্ব এই যে, তাহার মধ্যে বয়সের তফাত কিছুমাত্র ছিল না-ছোটদের সঙ্গে অনায়াসে এবং আনন্দে ছোট হইয়া গিয়াছিল। সঙ্গে কতগুলি ছবিওয়ালা ছেলেদের গল্পের বই-তহারই কোনো-একটা বিশেষ গল্প শোনাইবার জন্য মেয়েরা তাহাকে ধরিয়া পড়িল। এ গল্পে নিশ্চয় তারা বিশ-পঁচিশ বার শুনিয়াছে। মেয়েদের কেন যে এত আগ্রহ তাহা বুুঝিলাম। গেন সুধাকন্ঠের সোনার কাঠিতে সকল কথা যে সোনা হইয়া ওঠে। তাই মেয়েরা যখন তার মুখে গল্প শোনে তখন গল্প নয়, তাহাকেই শোনে; তাহাদের হৃদয়ের উপর প্রাণের ঝর্ণা ঝরিয়া পড়ে। তার সেই উদ্ভাসিত প্রাণ আমর সেদিনকার সমস্ত সূর্যকিরণকে সজীব করিয়া তুলিল; আমার মনে হইল, আমাকে যে প্রাকৃতি তাহার আকাশ দিয়া বেষ্টন করিয়াছে সে ঐ তরুণীরই অক্লান্ত অম্নান প্রাণের বিশ্বব্যাপী বিস্তার। পরের স্টেশনে পৌঁছাতেই খাবারওয়ালাকে ডাকিয়া সে খুব খানিকটা চান-মুঠ কিনিয়া লইল এবং মেয়েদের সঙ্গে মিলিয়া নিতান্তে ছেলেমানুষের মতো করিয়া কলহস্য করিতে করিতে অসংকোচে খাইতে লাগিল। আমার প্রকৃতি যে জাল দিয়া বেড়া-আমি কেন বেশ সহজে হাসিমুখে মেয়েটির কাছে এই চানা একমুঠা চাহিয়া লইতে পারিলাম না। হাত বাড়াইয়া দিয়া কেন আমার লোভ স্বীকার করিলাম না। মা ভালো-লাগা এবং মন্দ -লাগার মধ্যে দোমনা হইয়াছিলেন। গাড়িতে আমি পুরুমানুষ,তবু ইহার কিছুমাত্র সংকোচ নাই,বিশেষত এমন লোভীর মতো খাইতেছে সেটা ঠিক হইতেছিল না; অথচ ইহাকে বেহায়া বলিয়াও তাঁর ভ্রম হয় নাই। তাঁর মনে হইল এ মেয়ের বয়স হইয়াছে কিন্তু শিক্ষা হয় নাই। মা হঠাৎ কারও সঙ্গে আলাপ করিতে পারেন না। মানুষের সঙ্গে দূরে দূরে থাকাই তাঁর অভ্যাস। এই মেয়েটির পরিচয় লইতে তাঁর খুব ইচ্ছা,কিন্তু স্বাভাবিক বাধা কাটাইয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না।
এমন সময়ে গাড়ি একটা বড়ো স্টেশনে আসিয়া থামিল। সেই জেনারেল-সাহেবের একদল অনুসঙ্গী এই স্টেশন হইতে উঠিবার উদযোগ করিতেছে। গাড়িতে কোথাও যায়গা নাই। বার বার আমদের গাড়ির সামনে দিয়া তারা ঘুরিয়া গেল। মা তো ভয়ে আড়ষ্ট, আমিও মনের মধ্যে শান্তি পাইতেছিলাম না।
গাড়ি ছাড়িবার অল্পকাল-পূর্বে একজন দেশি রেলওয়ে কর্মচারী নাম-লেখা দুইখানা টিকিট গাড়ির দুই বেঞ্চের শিয়রের কাছে লটকাইয়া দিয়া আমাকে বলিল,”এ গাড়ির এই দুই বেঞ্চে আগে হইতেই দুই সাহেব রিজার্ভ করিয়াছেন, আপনাদিগকে অন্য গাড়িতে যাইতে হইতেব।”
আমি তো তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। মেয়েটি হিন্দিতে বলিল,”না, আমরা গাড়ি ছাড়িব না।”
সে লোকটি রোখ করিয়া বলিল, ”না ছাড়িয়া উপায় নাই।”
কিন্তু মেয়েটির চলিষ্ণুতার কোনো লক্ষণ না দেখিয়া সে নামিয়া গিয়া ইংরেজ স্টেশন-মাস্টারকে ডাকিয়া আনিল। সে আসিয়া আমাকে বলিল,”আমি দুঃখিত, কিন্তু-”
শুনিয়া আমি ’কুলি কুলি’ করিয়া ডাক ছাড়িতে লাগিলাম। মেয়েটি উঠিয়া দুই চক্ষে অগ্নিবর্ষণ করিয়া বলিল,”না, আপনি যাইতে পারিবেন না,যেমন আছেন বসিয়া থাকুন।”
বলিয়া সে দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া স্টেশন-মাস্টারকে ইংরেজি ভাষায় বলিল,”এ গাড়ি আগে হইতে রিজর্ভ কর,এ কথা মিথ্যা কথা।”
বলিয়া নাম লেখা টিকিটটি খুলিয়া প্লাটফর্মে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল।
ইতিমধ্যে আর্দালি-সমেত ইউনিফর্ম -পরা সাহবে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। গড়িতে সে তার আসবাব উঠাইবার জন্য আর্দালিকে প্রথমে ইশারা করিয়াছিল। তারপর মেয়েটির মুখে তাকাইয়া, তার কথা শুনিয়া,ভাব দেখিয়া, স্টেশন-মাস্টারকে একটু স্পর্শ করিল এবং তাহাকে আড়ালে লইয়া গিয়া কী কথা হইল জানি না। দেখা গেল, গাড়ি ছাড়িবার সময় অতীত হইলেও আর-একটা গাড়ি জুড়িয়া তবে ট্রেন ছাড়িল। মেয়েটি তার দলবল লইয়া আবার একপত্তন চানা-মুঠা খাইতে শুরু করিল, আর আমি লজ্জায় জানালার বাহিরে মুখ বাড়াইয়া প্রকৃতির শোভা দেখিতে লাগিলাম।
কানপুর গাড়ি আসিয়া থামিল। মেয়েটি জিনিসপত্র বাঁধিয়া প্রস্তুত স্টেশনে একটি হিন্দুস্তানি চাকর ছুটিয়া আসিয়া ইহাদিগকে নামাইবার উদ্যেগ করিতে লাগিল।
মা তখন আর থাকিতে পারিলেন না। জিজ্ঞাস করিলেন,”তোমার নাম কী মা।”
মেয়েটি বলিল, ”আমার নাম কল্যাণী।”
শুনিয়া মা এবং আমি দুজনই চমকিয়া উঠিলাম।
”তোমর বাবাÑ”
”তিনি এখানকার ডাক্তার, তাঁহার নাম শম্ভুনাথ সেন।”
তার পরেই সবাই নামিয়া গেল।
মামার নিষেধ অমান্য করিয়া, মাতৃ-অজ্ঞা ঠেলিয়া, তার পরে আমি কানপুরে আসিয়াছি। কল্যানীর বাপ এবং কল্যানীর সঙ্গে দেখা হইয়াছে। হাত জোড় করিয়াছি, মাথা হেঁট করিয়াছি; শম্ভুনাথবাবুর হৃদয় গলিয়াছে। কল্যাণী বলে, আমি বিবাহ করিব না।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,”কেন।”
সে বলিল,”মাতৃ-অজ্ঞা।”
কী সর্বনাশ। এ পক্ষেও মাতুল আছে নাকি।
তার পরে বুঝিলাম, মাতৃভূমি আছে। সেই বিবাহ-ভাঙার পর হইতে কল্যাণী মেয়েদের শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করিয়াছে।
কিন্তু আমি আশা ছাড়িতে পারিলাম না। সেই সুরটি যে আমার হৃদয়ের মধ্যে আজও বাজিতেছে-সে যেন কোন ওপারের বাঁশি-আমার সংসারের বাহির হইতে আসিল-সমস্ত সংসারের বাহিরে ডাক দিল। আর, সেই-যে রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে আমার কানে আসিয়াছিল ”জয়গা আছে”. সে যে আমার চিরজীবনের গানের ধুয়া হইয়া রহিল। তখন আমার বয়স ছিল তেইশ, এখন হইয়াছে সাতাশ। এখনো আশা ছাড়ি নাই, কিন্তু মাতুলকে ছাড়িয়াছি। নিতান্ত এক ছেলে বলিয়া মা আমাকে ছাড়িতে পারেন নাই।
তোমার মনে করিতেছ, আমি বিবাহের আশা করি? না, কোন কালেই না। আমার মনে আছে, কেবল সেই এক রাত্রির অজানা কন্ঠের মধুর সুরের আশা-জায়গা আছি। নিশ্চই আছে। নইলে দাঁড়াব কোথায়। তাই বৎসরের পর বৎসর যায় আমি এইখানেই আছি। দেখা হয়, সেই কন্ঠ শুনি, যখন সুবিধা পাই কিছু তার কাজ করিয়া দিই-আর মন বলে,এই তো জায়গা পাইয়াছি।ওগো অপরিচিতা,তোমার পরিচয়ের শেষে হইল না, শেষ হইবে না; কিন্তু ভাগ্য আমার ভালো,এই তো আমি জায়গা পাইয়াছি।

0 comments:

Post a Comment